মহাত্মা গান্ধীকে ভারত ও বিশ্বের প্রয়োজন কেন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ব্রিটিশ শাসনবিরোধী অহিংস আন্দোলনের নেতা ও ভারতের জাতির জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী; যিনি মহাত্মা গান্ধী নামে পরিচিত। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে তার নাম।১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজকীয় প্রাদেশিক এলাকা পোরবন্দরে গান্ধীর জন্ম।

ভারতীয় উপমহাদেশের অবিসংবাদিত এই নেতার জন্মদিনে মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি নিবন্ধ লিখেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ইংরেজিতে লেখা নিবন্ধের বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হলো :

১৯৫৯ সালে ভারতে পা রাখার পর মার্টিন লুথার কিং (জুনিয়র) বলেছিলেন, অন্য দেশে আমি পর্যটক হিসেবে যাই। তবে ভারতে আমি একজন তীর্থযাত্রী হিসেবে এসেছি। তিনি আরো বলেছিলেন, ভারতীয় ভূমি থেকেই সমাজে অহিংস পদ্ধতির প্রসার ঘটেছে। মন্টেগোমারি, অ্যালাবামায় এবং দক্ষিণ আমেরিকায় আমার লোকেরাও তাতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। অহিংসার এই পদ্ধতিকে আমরা কার্যকরী ও দীর্ঘমেয়াদী মনে করেছি; নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কার্যকরী!

যার অনুপ্রেরণা ড. কিংকে (জুনিয়র) ভারতে নিয়ে এসেছিল, তিনি হলেন মোহনদাস করমচন্দ গান্ধী- মহাত্মা, এক মহান আত্মা। বুধবার, তার সার্ধশতবর্ষ পালন করছি আমরা। গান্ধীজি বা বাপু, যে নামেই তাকে স্মরণ করি না কেন, আজও তিনি বিশ্বের লক্ষাধিক মানুষের কাছে সাহসের প্রতীক।

শুধু ভারত নয়, গান্ধীর অহিংস প্রতিরোধের বার্তা বহু আফ্রিকান দেশেও আশার আলো জাগিয়েছিল। ড. কিংয়ের কথায়, আমি যখন পশ্চিম আফ্রিকার ঘানাতে গিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী নক্রুমাহ আমায় জানিয়েছিলেন যে তিনি গান্ধীর কাজ সম্পর্কে পড়াশোনা করেছেন এবং অহিংসার মাধ্যমে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ তার দেশেও ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব বলে মনে করছেন। আমাদের মনে আছে, দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস বয়কটও হয়েছিল।

গান্ধীকে ‘পবিত্র যোদ্ধা’ আখ্যা দিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা লিখেছিলেন, তার অসহযোগিতার কৌশল, নিশ্চিত ধারণা যে শাসকের সঙ্গে সহযোগিতা আদতে সেই শাসন স্বীকার এবং তার অহিংস প্রতিবাদ আমাদের দেশের ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী এবং বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

ম্যান্ডেলার কাছে গান্ধী ছিলেন ভারতীয় এবং দক্ষিণ আফ্রিকান। গান্ধীও তাতে সহমত পোষণ করতেন। মানব সভ্যতার বহু বিতর্কিত দ্বন্দ্ব সমাধানে সেতু হওয়ার মতো দক্ষতা ছিল তার।

১৯২৫ সালে ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’য় গান্ধী লিখেছিলেন, ‘‘জাতীয়তাবাদী না হয়ে কেউ আন্তর্জাতিকতাবাদী হতে পারবেন না। জাতীয়তাবাদ সম্ভব হলে, তবেই আন্তর্জাতিকতাবাদ বাস্তব হতে পারে। অর্থাৎ যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা সংগঠিতভাবে একত্রিত হতে পারে।’’ সংকীর্ণ বা স্বতন্ত্র নয়, সমস্ত মানবসভ্যতার জন্য কাজ করবে এমন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তিনি।

শ্রমিক-স্বার্থে মজুর মহাজন সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গান্ধী। বাইরে থেকে সামান্য প্রতিষ্ঠান মনে হলেও ছোট ছোট পদক্ষেপে বড় ভূমিকা নিয়েছিল এই সংগঠন। তখনকার সময়ে ধনীদের সম্মানে ‘মহাজন’ বলা হতো। মজুর বা শ্রমিকের সঙ্গে মহাজন জুড়ে সামাজিক গঠনতন্ত্র বদলে ফেলেছিলেন গান্ধী। ভাষার ব্যবহারে শ্রমিকদের সম্মান বৃদ্ধি করেছিলেন গান্ধী।

সাধারণ বস্তুর সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির সংযোগ ঘটিয়েছিলেন গান্ধী। চড়কা এবং খাদির কাপড়কে দেশের ক্ষমতায়ন ও আর্থিক স্বনির্ভরতার সঙ্গে আর কেউ বা মেলাতে পারতেন?

সামান্য লবণ বা নুন থেকে গণ-আন্দোলনের সূত্রপাত আর কেউ বা করতে পারতেন! ঔপনিবেশিক শাসনকালে লবণ আইনে ভারতীয় লবণ উৎপাদনের ওপর নয়া কর বসানো হয়েছিল। ১৯৩০ সালে পায়ে হেঁটে ডান্ডি পৌঁছে ব্রিটিশ সরকারের লবণ আইনকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন গান্ধী। ঐতিহাসিক ডান্ডি অভিযান থেকেই বৃহত্তর আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল।

বিশ্বে বহু গণআন্দোলন হয়েছে। ভারতেও স্বাধীনতার জন্য বহু লড়াই হয়েছে। তবে বৃহৎ সংখ্যায় সাধারণ মানুষের যোগদানই গান্ধীর অহিংস আন্দোলন এবং তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে সৃষ্ট আন্দোলনগুলোকে আলাদা করে। আজীবন নির্বাচিত এবং প্রশাসনিক পদ থেকে দূরে থেকেছেন। কোনোদিন ক্ষমতার লোভ তাকে ছুঁতে পারেনি।

তার কাছে স্বাধীনতা মানে শুধুই বহিরাগত শাসন থেকে মুক্তি ছিল না। রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত ক্ষমতায়নের মধ্যে সংযুক্তির সম্ভাবনা দেখেছিলেন তিনি। প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সমান মর্যাদা ও সমান বিকাশ থাকবে, এমন বিশ্বের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তিনি। গোটা বিশ্ব যখন অধিকারের দাবি করছিল, গান্ধী তখন দায়িত্বের ওপর জোর দিয়েছিলেন। ‘ইয়ং ইন্ডিয়ায়’ তিনি লিখেছেন, ‘‘অধিকারের আসল সূত্র হল দায়িত্ব। আমরা সবাই যদি দায়িত্বমুক্ত হই, অধিকারও দূরে সরে যাবে।’’ হরিজন পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন, যিনি নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন, অধিকার তার হাতেই আসবে।

গরীবদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য ট্রাস্টের ধারণার সূচনা করেছিলেন গান্ধী। তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আমাদের অধিকারের ধারণা নিয়ে ভাবা উচিত। উত্তরাধিকারী হিসেবে পৃথিবীর ভালোমন্দের জন্য আমাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। উদ্ভিদ ও অন্য প্রাণিজগৎকেও রক্ষা করতে হবে।

আদর্শের রাস্তার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাই গান্ধীর মধ্যে। মানবতায় বিশ্বাসকারীদের একত্রিত করার পাশাপাশি বহুমুখী উন্নয়ন এবং আর্থিক স্বনির্ভরতা; সব সমস্যার সমাধানই দিয়েছেন গান্ধী।

ভারতেও আমরা একই চেষ্টা করছি। দারিদ্র্য দূর করার প্রচেষ্টায় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে এগিয়ে ভারত। আমাদের স্বচ্ছতার প্রয়াস বিশ্বের নজর কেড়েছে। আন্তর্জাতিক সৌরশক্তি জোটের মাধ্যমে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সম্পদ উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছি আমরা এবং এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য সৌরশক্তিকে ব্যবহার করতে আগ্রহী দেশগুলোকে কাছাকাছি এনেছে। বিশ্বের সঙ্গে বিশ্বের জন্য আরও উদ্যোগে আগ্রহী আমরা।

গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধায় আমি আইনস্টাইন চ্যালেঞ্জের সূচনা করেছি, গান্ধীর জন্য অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের বিখ্যাত উক্তি সম্পর্কে আমরা জানি, ‘ভবিষ্যতের মানুষ বিশ্বাসই করবে না যে রক্ত-মাংসের এমন একজন মানুষ একদিন এই পৃথিবীতে পা রেখেছিলেন।’ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে গান্ধীর মতাদর্শকে কীভাবে সংরক্ষিত করব আমরা? গান্ধীর আদর্শের প্রসারে সচেষ্ট হতে টেক-গুরু, শিল্পোদ্যোগী এবং চিন্তাশীল ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

বিশ্বকে ঘৃণা, হিংসা ও যন্ত্রণা-মুক্ত করতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমাদের উদ্যোগী হওয়া উচিত। তখনই আমরা মহাত্মা গান্ধীর স্বপ্ন পূরণ করব। মনে রাখা উচিত গান্ধীর প্রিয় ‘বৈষ্ণব জন তো।’ যা অনুযায়ী, যিনি অন্যের যন্ত্রণা অনুভব করেন, দুঃখ দূর করেন এবং কখনও দম্ভ দেখান না, তিনিই প্রকৃত মানুষ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর